জাদু, জাদুকর ও জাদুকরী বিদ্যা

52

জাদু সভ্যতা বিকাশের লগ্ন থেকে মানব সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। তবে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২৭০০ সালে মিশরের একজন ব্যক্তি Dedi প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাদুর চর্চা চালু করেন। তিনি তার দর্শকদের মোহাচ্ছন্ন করত: একটি প্রভাব বলয় তৈরি করতেন এবং এই ফাঁকে কারসাজি দেখাতেন। জাদুকে মূলত দু’টো ভাগে বিভক্ত করা যায়, বিনোদনমূলক জাদু যা অনেকটা আর্ট/শিল্প এবং ব্ল্যাক ম্যাজিক বা উইচক্র্যাফট। “Abracadabra” প্রাচীন জাদুকরদের একটি খুব প্রচলিত শব্দ ছিল, যা মানুষকে মোহাবিষ্ট করতে পারতো বলে বিশ্বাস করা হতো।

বিনোদনমূলক জাদুতে মূলত কৌশলে দর্শকের চোখকে ফাঁকি দেয়া কিংবা দর্শকের মনকে কোনভাবে মোহাচ্ছন্ন করে রাখা মুখ্য উপায় হয়ে থাকে (প্রাচীন কালে রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে ঘাটাঘাটিকারী “আল কেমি” দের বদান্যতায় “জাদুকরী” কলা কৌশল বেড়ে গিয়েছিল)। এর বাইরেও এখানে অতীন্দ্রিয় একটি বিষয় থাকতে পারে, যার ব্যাখ্যা পরিষ্কার নয়। হুডিনি, ডেভিড কপারফিল্ড, পিসি সরকার, জুয়েল আইচ প্রমূখ বিখ্যাত জাদু শিল্পী।

ব্ল্যাক ম্যাজিক একটি ভয়ানক বিষয়। যে কোনো ধর্ম বিশ্বাসে এর নেতিবাচক অস্তিত্ব রয়েছে। সচরাচর অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় দীক্ষিত ও প্রকৃতি লব্ধ জ্ঞানে অভিজ্ঞ এমন ব্যক্তিবর্গ “ইভিল ম্যাজিক” বা ব্ল্যাক ম্যাজিক বা উইচক্র্যাফট এ পারদর্শী হতো। সমাজে এ ধরনের জাদুর কারবার “ফোক ম্যাজিক” বা “ট্র্যাডিশনাল ম্যাজিক” হিসেবেও পরিচিত ছিল। উচ্চবিত্তরা এদের অবজ্ঞা করলেও গোপনে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সহযোগিতা গ্রহণ করতো। মধ্যযুগে ইউরোপে উচ্চবিত্তের মাঝেও ব্ল্যাক ম্যাজিকের মতোই “স্যাটানিক প্র্যাকটিস” চালু ছিল, যাকে এলিট ভাব নিয়ে “হোয়াইট ম্যাজিক” বলা হতো (ক্রিস্টোফার মারলো’র “ডক্টর ফষ্টাস” নাটকে এটি সুন্দরভাবে চিত্রায়িত হয়েছে) । অবশ্য পরে এ শ্রেণী বিভাজন গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি।

“ব্ল্যাক ম্যাজিক” চর্চা নিতান্তই জটিল ও দুরূহ। যে কারো দ্বারা কিংবা যে কোন সহজ উপায়ে এটি আয়ত্ত্ব করা সম্ভব নয়। এর জন্য নির্দিষ্ট পরিবেশে ধর্মে নিষিদ্ধ গোপন ও রহস্যমূলক দীক্ষা নিতে হয়। ভালো কিছুর জন্য ব্ল্যাক ম্যাজিক প্রয়োগ করা হয় না, তাই সচরাচর ভালো মনের মানুষ এ ধরনের চর্চায় যায় না। শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্ল্যাক ম্যাজিক ব্যবহার করা হয়। ধর্ম গ্রন্থের কিছু বিশেষ বাণী বা শ্লোক আয়ত্ত্ব কিংবা বংশপরম্পরা বা গুরুর সূত্রে বহু বছরের ধারাবাহিকতায় প্রচলিত কিছু তন্ত্র-মন্ত্র দীক্ষা অথবা বদ জিন হাজিরা ব্ল্যাক ম্যাজিকের মূল গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তন্ত্রের মাধ্যমে কিভাবে একজন ওঝা বা তান্ত্রিক তার লক্ষ্য বস্তু মানুষকে “বান” মেরে আক্রান্ত করতে পারে তা একটি বিস্ময়কর বিষয়। এখানে প্রকৃতির বিজ্ঞান কাজ করে। প্রচলিত ব্যাখ্যা এই যে, কালো জাদু হলো কোন এক রহস্যজনক কৌশলে সমাজের বিশেষ জ্ঞান ও কর্মকাণ্ডে অভিজ্ঞ জন কর্তৃক সর্বপ্রাণ ও আত্মার সন্তুষ্টির কামনায় অতীন্দ্রীয় শক্তিকে বশীভূত করার প্রচেষ্টা। এজন্য তারা এমনকি মৃতের আত্মার সাথে কোন এক রহস্যজনক উপায়ে যোগাযোগ করে, এমনও বলা হয়ে থাকে।

একজন তান্ত্রিক তার ভিকটিম মানুষের ব্যবহার্য কোন বস্তু বা কাপড়চোপড়, তার শরীরের কোন একটি অংশ, চুল ইত্যাদি নিয়ে তন্ত্র-মন্ত্র পড়ে ওই ভিকটিমকে ঘায়েল করতে পারে। এই ঘায়েল করার আবার মাত্রা আছে। বানের শক্তির উপর নির্ভর করে ভিকটিম সাময়িক অসুস্থ থাকবে, নাকি দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থ থাকবে, নাকি মারা যাবে। এ প্রক্রিয়ায় বানের অস্ত্র হিসেবে কোন খাবার দাবার, যেমন: বিস্কিট, লৌহজাতীয় বস্তু (পেরেক, সূঁচ), পুতুল ইত্যাদি সাধারণত ব্যবহারিত হয়। কোন একজন ভিকটিমের নামে গাছে পেরেক মারা, পুতুলে অসংখ্য সূচ ফোটানো, পুকুরে বা কবরে তাবিজ ফেলে দেয়া ইত্যাদি ব্ল্যাক ম্যাজিকের সবচেয়ে খারাপ অংশ।

মানব সমাজে পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবণতা রয়েছে এমন অনগ্রসর গোষ্ঠী সাধারণত কালো যাদুবিদ্যার ধারক ও বাহক হয়ে থাকে। আফ্রিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে “ভুডু” বা ডাকিনি বিদ্যা (এর উৎস আফ্রিকার বেনিন নামক রাষ্ট্র যেখানে যাদুবিদ্যা একটি সাধারণ পেশা), প্রাচীন আইরিশ সমাজে “বানশি”, ভারতীয় উপমহাদেশের “তান্ত্রিক”, ডাইনি, জাপানের “ওনমিউজি”, তুরস্কের “সিচ্চিন” সাধক ইত্যাদি কালো জাদুকরি বা ডাকিনি বিদ্যার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি বিশেষের নামকরণ।

জাদু-টোনা কখনোই ভালো জিনিস নয়। ধর্মগুলোতে এটি হয় নিষিদ্ধ, নয় নিরুৎসাহিত হয়েছে। ইসলাম ধর্মে এটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং পবিত্র কোরআন শরীফে জাদু-টোনা নিয়ে দু’টি সুরা আছে। কালো জাদু বিদ্যা যতই বিপদজনক হোক না কেন, মানুষের মাঝে বিরাজমান দ্বন্দ্বকলহ, শত্রুতা, লোভ-হিংসা, ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি কারণে সমাজের অনগ্রসর, আধুনিক শিক্ষাবিহীন কোন এক স্বতন্ত্র ব্যক্তি নিয়ন্ত্রিত কালো জাদুবিদ্যার গোপন জনপ্রিয়তা রয়েছে। এটি এতো ভয়ানক যে, বলা হয়ে থাকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানও কালো যাদুবিদ্যার শিকার ব্যক্তিকে সুস্থ করতে পারে না। অতএব মানব সমাজের এই অন্ধকার জগত সম্পর্কে সকলকে সচেতন থাকা আবশ্যক।

লেখক: ওয়াহিদ আজাদ