প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অধীনে বাংলাদেশের ভবিষ্যত: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

6

জহিরুল ইসলাম: আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২৪ সালে দ্বিতীয়বারের মত জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এই নির্বাচনে ট্রাম্প বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে পরাজিত করে। ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে প্রত্যাবর্তন আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বিশ্ব অর্থনীতির ওপর নানা প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যও তার নতুন প্রশাসনের বিদেশনীতি গুরুত্বপূর্ণ। গনঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের বিদেশনীতি কেমন হবে তা এখন দেখার বিষয় এবং সময়সাপেক্ষ। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের জন্য ট্রাম্পের বিদেশ নীতি কতটুক চ্যালেঞ্জিং তা সময়ই বলে দিবে।

২০২৪ সালে দায়িত্বগ্রহণের পর ট্রাম্প তার “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি পুনরায় কার্যকর করেছেন। এর আওতায়, তিনি আমেরিকার বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে ব্যাপক পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করেছেন। এই পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে ট্রাম্প আমেরিকান কোম্পানিগুলোর জন্য সুরক্ষা প্রদান করতে চান। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া পণ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, এখন নতুন শুল্ক নীতি ও কঠোর বাণিজ্য নীতির মুখোমুখি হতে পারে। এতে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য প্রবেশাধিকার কিছুটা সীমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ট্রাম্পের সুরক্ষা নীতি বাংলাদেশের একমাত্র রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পখাতকে প্রভাবিত করতে পারে (যেখান থেকে বিজিএমইএ’র হিসেবে গেলো বছর এসেছে ৪৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এরমধ্যে একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি আয় এসেছে আমেরিকা থেকে ৭.২৯ বিলিয়ন ডলার) যেটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কাও হতে পারে। এই দিকে বাংলাদেশের রপ্তানিতিতে বৈচিত্রতা না থাকার কারণে অতিমাত্রায় পোশাক শিল্পে নির্ভশীলতা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি শিল্প চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতি কেমন হবে আমেরিকার সাথে তা এখনি ভাবনার বিষয় বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের।

মানবাধিকার সংক্রান্ত কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে শীতলতা চলছিলো। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকার এবং আমেরিকার বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় তা প্রকাশ পেয়েছিলো। যা সর্বেশেষ বাংলাদেশের র‍্যাব ও বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমেই তা প্রকাশ পেয়েছিলো। তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কে অনেকটাই উষ্ণতা দেখা গেছে। যা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে তার উচ্ছ্বসিত ছবিতেও সেটি দেখা গিয়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে মানবাধিকার ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে অবস্থান পরিবর্তন হতে পারে। পূর্ববর্তী ডেমোক্র্যাটিক প্রশাসনগুলো সাধারণত বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছিল। তবে ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির আওতায়, যুক্তরাষ্ট্র এখন নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, ফলে মানবাধিকার ও শ্রমিক সুরক্ষা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপ কমার সম্ভাবনা রয়েছে।

ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় এসে চীন ও রাশিয়ার প্রতি কড়া অবস্থান নিয়েছেন। বিশেষ করে, চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে, কারণ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চীনের সাথে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে। ট্রাম্পের চীন-বিরোধী অবস্থান বাংলাদেশের ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে, কারণ বাংলাদেশকে এখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে বাংলাদেশকে নিজের অবস্থান সুরক্ষিত রাখতে কৌশলী হতে হবে।

ট্রাম্পের পূর্ববর্তী কার্যকালে জলবায়ু পরিবর্তন নীতি নিয়ে তার অবস্থান বেশ বিতর্কিত ছিল। তিনি প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছিলেন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে গড়িমসি করেছিলেন। তার পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর এই অবস্থান বজায় থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি। ট্রাম্প প্রশাসন থেকে আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলে অবদান কমে গেলে বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আর্থিক সহায়তা কমতে পারে, যা বাংলাদেশকে বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকা রক্ষায় সমস্যার মুখে ফেলবে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ এক মিত্র। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক জোরদার করা বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তার প্রশাসন বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিষয়ে তেমন মনোযোগ না দিতে পারে, যা কিছু বিতর্কিত বিষয়কে প্রাধান্য এনে সম্পর্ককে আরও জটিল করতে পারে। তবে ট্রাম্পের সাথে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হলে তা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুবিধা বয়ে আনতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে কিছু কৌশল গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে বৈদেশিক নীতি পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, শ্রমিক অধিকার ও মানবাধিকার সংক্রান্ত যে কোনো নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা। তৃতীয়ত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে বাংলাদেশকে বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করতে হবে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে বৈশ্বিক রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাংলাদেশের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। বাণিজ্য, জলবায়ু এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এই নতুন পরিস্থিতি বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে। বাংলাদেশের উচিত এই পরিবর্তনশীল পরিবেশে কৌশলী ও স্থিতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে দেশটি নিজের উন্নয়ন ও ভবিষ্যত সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তজার্তিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়