চয়ন মজুমদারঃ সুন্দরবনের দক্ষিণে অবস্থিত দুবলার চরে চলেনা সরকারের শাসন। সাগর, বন সবখানেই যেন সাহেবদের (মহাজন) আধিপত্য । তাদের নিয়ন্ত্রনে চলছে চরের অন্তত ২০ হাজার জেলের জীবন- জীবিকা। তাই হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও ভাগ্যের বদল হচ্ছেনা দুবলার চরের জেলেদের।
গত ১৪ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এই চরে সচল একটি মাত্র মুঠোফোন কোম্পানির নেটওয়ার্ক। তবে যেদিন বেশি মাছ ধরা পড়ে সেদিনই বন্ধ ডাঙ্গার সাথে যোগাযোগ। আর এই সুযোগে পানির মাছ পানির দামে কিনে নেয় সাহেরদের লোকজন। জেলেরা সুবিশাল এই জেলে পল্লীতে একসময় ছিলেন দস্যুদের টার্গেট। তবে র্যাবের তৎপরতায় সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হলেও সংকট পিছু ছাড়েনি তাদের।
এদিন তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, বছরে সাত মাস দুবলার চর থাকে ফাঁকা। থাকেনা মানুষের তেমন পদচারণা। বাকি পাঁচ মাস লোকে লোকারণ্য, বিভিন্ন জেলা থেকে আসা প্রান্তিক জেলেরা গড়ে তোলেন বসতি। সাগর ও নদী থেকে ধরে আনা মাছ এখানে শুকানো হয় রোদে। সরকার প্রতি বছর এই শঁটকি পল্লী থেকে ছয় থেকে সাত কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে। একদিকে সিন্ডিকেট, অন্যদিকে সাহেবরা খায় লাভের অংশ। আরেকদিকে সরকার নেয় রাজস্ব। কিন্তু জেলেদের নিয়ে ভাবেনা কেউ।
জেলেরা অভিযোগ করেন, সুন্দরবন জলদস্যু মুক্ত হয়েছে। নেই মুক্তিপনের আতংক। তারপরও দুবলার চরে হাসি নেই জেলেদের মুখে। এর কারণ দুবলার চরে কারা মাছ ধরবেন, বিক্রি করবেন কোন ব্যবসায়ীর কাছে বা চিংড়ি, লইট্যা, ছুরি মাছের দাম কত হবে-সবই ঠিক করেন প্রভাবশালী কথিত সাহেবরা। এমন কয়েকজন ব্যক্তি নিয়ন্ত্রন করেন এই চর। জেলেদের কাছে তাদের নাম ‘সাহেব’। এই সাহেবরাই জিম্মি করে রেখেছেন ৯৮৫ জেলে-মহাজনসহ প্রায় ২০ হাজার মৎস্যজীবিকে।
এ বিষয়ে দুবলার চরে মাছ ধরতে আসা জেলে নজরুল ফকির বলেন, ‘ক্ষমতা সব সাহেবদের। কামাল সাহেব, টোকেন সাহেব, কামরুল সাহেবসহ অনেক সাহেব আছে এখানে। এই সাহেবদের কাছ থেকে দাদন (অগ্রিম টাকা নেওয়া) নিতে হবে। এক লাখ টাকা নিলে পাঁচ লাখ টাকার মাছ বুঝে নিবেন তারা। মহাজন বা সাহেবদের কারবার হওয়ায় কোন মাছ বাইরে বিক্রি করা যায়না। জলদস্যু না থাকলেও এই সাহেবদের অত্যাচারে জেলেরা বন্দি আছে। এখান থেকে আমরা মুক্তি চাই’।
আরেক জেলে সেলিম মাঝি বলেন, ‘এই চরের রাঘববোয়ালদের হাত থেকে সরকার আমাদের উদ্ধার করুক। যাদের লাইসেন্সসে এখানে মাছ ধরা হয় সেই সাহেবদের অর্ধেকের বেশি মাছ বুঝিয়ে দিতে হবে। কথা বলার কোন অধিকার নাই। এভাবে দিতে দিতে জেলেদের ছেঁড়া জাল আর ভাঙ্গা ট্রলার নিয়ে বাড়ী ফিরে যেতে হয়।
৫০ হাজার টাকা ঋন নিয়ে দুবলার চরে মাছ ধরতে আসা জাহাঙ্গীর হোসেন নামে এক জেলে বলেন, ‘রাত জেগে রোদে পুড়ে সাগরে মাছ ধরতে হয়, অনেক কষ্ট। এরপর সাহেবদের কাছে সেই মাছ বিক্রি না করলে গালাগাল করে নির্যাতন করে’।
এদিকে শীত মৌসুমে দুবলার চরে জেলে ও অন্যান্য কর্মি মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার লোক বাস করেন। কিন্তু সেখানে নেই কোন মেডিকেল ক্যাম্প, নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থাও।
এ বিষয়ে জেলে নাহিদুল ইসলাম মৃধা বলেন, এখানে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই, চরের কুয়া থেকে পানি উঠিয়ে সে পানি খেতে হয়। এতে পেটে অনেক সমস্যা হয়। এছাড়া এখানে হাসপাতালের কোন ব্যবস্থা নেই, সে কারণে তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে পর্যাপ্ত চিকিৎসারও কোন ব্যবস্থা নেই।
ইয়াছিন শেখ নামে আরেক জেলে বলেন, সাগরে মাছ ধরতে গেলে অনেক সময় ‘পানিসাপ’ নামে এক ধরণের বিষক্ত সাপেড় কামড় খেতে হয়। এজন্য এখানে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা রাখা হলে তাদের জীবনের ঝুঁকি কমে যেতো। এছাড়া অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে দুবলার চর থেকে তাদেরকে নদী পথে বাগেরহাট বা খুলনায় হাসপাতালে নিতে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা সময় লাগে। এজন্য জরুরিভাবে একটি সরকারি হাসপাতালের দাবি করেন তারা।
জানা যায়, সুন্দরবনে দুবলার চরে শুঁটকির ব্যবসায় এক সময়ে পুরোটাই নিয়ন্ত্রন করতেন প্রয়াত (অবঃ) মেজর জিয়া উদ্দিন। এখন সে নিয়ন্ত্রন হাত ঘুরে তার ভাই এবং দুবলার কথিত সাহেবের কাছে। জেলেদের ওপর নির্যাতন আর শোষনের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। বলেন-‘জেলেদের এই অভিযোগ কতটুকু সত্য তা আমার জানা নেই, এখানে দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের একটি সমিতি আছে। জেলেরা চাইলে সমিতিতে অভিযোগ দিতে পারেন। এরপর এর সুষ্ঠু সমাধান করা যেতে পারে’।
কিন্তু দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপ সমিতির খোদ কামাল উদ্দিন আহম্মেদই কয়েকযুগ ধরে সাধারণ সম্পাদকের পদ আঁকড়ে রাখায় কোন জেলেরা অভিযোগ দিতে সাহস পায়না বলে জানা গেছে।
মাছ শিকার আর শুঁটকির মৌসুমে কথিত সাহেবদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিষয়ে জেলেরা লিখিত অভিযোগ দিলে দুবলার চরকে সাহেবমুক্ত করা হবে জানিয়ে পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মোঃ নুরুল করিম বলেন, দুবলার চরে সুপেয় পানির দীর্ঘ দিনের সমস্যা ছিল। কিন্তু এবার জেলেদের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষনের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর স্বাস্থ্য সেবার জন্য গত সোমবার (১৮ নভেম্বর) জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আলোচনা হয়েছে।
এসময় দুবলার চরে অন্তত একজন চিকিৎসক এবং পর্যপ্ত ওষুধের ব্যবস্থা করতে সিভিল সার্জনকে অনুরোধ করা হয়েছে। সিভিল সার্জন তাকে আশস্থ করেছেন।