নিজস্ব প্রতিবেদকঃ মাদক নিয়ন্ত্রণে আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক ও পূর্ব বিরোধের জের ধরে খুলনায় হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। আগের দুই মাসে খুলনা মহানগর ও জেলায় ১০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
এর বাইরে নারী নির্যাতন, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, লুটপাটের মতো সামাজিক অপরাধও বেড়েছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পাঁচ আগস্টের পর পুলিশ এখনো মাঠে পুরোপুরি সক্রিয় হয়নি। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এদিকে পর পর কয়েকটি হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। এসব অস্ত্রের উৎস খুঁজতে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।জানা গেছে, তিন ডিসেম্বর রাতে নগরীর নাজিরঘাট এলাকায় মো. ইউনুস শেখ নামে এক মাছ ব্যবসায়ীকে শটগান দিয়ে গুলি করা হয়। এ সময় দুটি গুলি তার পিঠে ও পায়ে বিদ্ধ হয়। এ ছাড়া ২৯ নভেম্বর রাতে টুটপাড়ার তালতলা হাসপাতাল এলাকায় খুলনা মৎস্য বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি আমির হোসেনকে গুলি করে ও কুপিয়ে আহত করা হয়। পরে চার ডিসেম্বর সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান।
নিহত আমির হোসেনের ছোট ভাই মো. আব্দুল্লাহ থানায় মামলা করেছেন। তিনি জানান, ২৯ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে ক্যারাম টুর্নামেন্ট দেখে বাসায় ফেরার পথে সন্ত্রাসীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার মাথায় ও ঘাড়ে কুপিয়ে জখম করে সন্ত্রাসীরা।
পরে স্থানীয়রা তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকার পর চার ডিসেম্বর তিনি মারা যান।
এর আগে ২১ নভেম্বর সোনাডাঙ্গা ক্লাসিক বোর্ড সেন্টারে প্রকাশ্যে হামলা চালিয়ে সাড়ে আটলাখ টাকা লুট করা হয়। এর প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা মানববন্ধন করেছেন। আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে দুই নভেম্বর রাতে শেরেবাংলা রোডে মো. রাসেল নামে আরেক যুবককে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
খুলনার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপংকর দাশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে মহানগর ও জেলার থানাগুলোতে ২৭৭টি মামলা রেকর্ড হয়, যা আগের মাসের তুলনায় ৪৫টি বেশি। দুই মাসে ১০টি হত্যা, ২১টি ধর্ষণ, চুরি ৫৩টি, ডাকাতি দুটি, নারী নির্যাতন ৩৬টি, অপহরণ ৬টি, মানবপাচার ৪টি ও মাদকের মামলা হয় ১৩৩টি। ২৮ নভেম্বর জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় খুলনা সদর, সোনাডাঙ্গা, খালিশপুর ও লবণচরা থানা এলাকাকে অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অপরাধ বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা খুলনার সমন্বয়কারী আইনজীবী মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ এখনো পুরোপুরি সক্রিয় না হওয়ায় সন্ত্রাসীরা মাথাচারা দিয়ে উঠেছে। পাঁচ আগস্টের পর কিছুদিন গা-ঢাকা দেওয়ার পর সন্ত্রাসীরা আবার এলাকায় ফিরেছে। আগের মতোই প্রভাব বিস্তার করে মাদকের রমরমা কারবার শুরু করেছে। তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকায় উদ্বেগ ছড়াচ্ছে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনা জেলা শাখার সম্পাদক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই খুদা বলেন, ‘যখন অপরাধীর বিচার হবে না, তখন অন্য অপরাধী আরও উৎসাহী হবে। প্রশাসন এখনই লাগাম টেনে না ধরলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।’
অপরাধমূলক কাজে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) শেখ মনিরুজ্জামান মিঠু বলেন, অবৈধ অস্ত্রের উৎস খুঁজতে পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী কাজ করছে।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, খুলনায় মাদককেন্দ্রিক অপরাধের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। মাদক বিক্রিতে পাড়া-মহল্লায় আধিপত্য বিস্তার করতে গডফাদাররা কৌশলে মাদক সিন্ডিকেট ও কিশোর গ্যাং গড়ে তুলছেন। এতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অক্টোবর মাসে নগরীতে ১৬৪টি মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়েছে। মামলা হয়েছে ৪৩টি। এসব মামলায় আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে ৪৭ জন। কর্মকর্তারা জানান, জনবলসংকটের কারণে মাদক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আগে মাদক অধিদপ্তরে অস্ত্রের অনুমোদন ছিল না, সম্প্রতি সেটা পাওয়া গেছে। অভিযান পরিচালনার জন্য যানবাহনের অভাব রয়েছে। মাত্র একটি গাড়ি নিয়ে অভিযানসহ অফিসের সব ধরনের কাজ চালাতে হয়।’