লোকটা // সৌমিত্র চক্রবর্তী’র মুক্তগদ্য

9

লোকটা

সৌমিত্র চক্রবর্তী

হেমন্ত কুয়াশা ঝরে পড়ছে টাপুর
টুপুর। দিগন্ত বিস্তৃত চর ও অচর
ঝাপসা আলো আঁধারি মায়ায়
অপেক্ষায় আছে, এক্ষুনি যেন ব্ল্যাক
ম্যাজিক দেখাবে কোনো আফ্রিকান
জাদুকর। গর্ভবতী চন্দ্রবোড়া সাপেরা
দশহাত মাটির তলায় নুড়ি আর
বালির লেপ তোষকে চিতোরগড়ের
রাণীর আনন্দে তোফা ঘুমের
জোগাড়ে ব্যস্ত। সারারাত শিশিরে
ভেজা সবুজ ঘাস ইতিউতি টুকটুক
গল্প করে। সদ্য কিশোরী ধান, বুকের
জমে ওঠা দুধের ভান্ডারে সিরসির
হাওয়া পেয়ে খিলখিল হাসে মাথা
দুলিয়ে। সূর্য এই উঠল বলে।

আলগোছে অনিমেষ ভাবনা ছড়িয়ে
সরু, কাটা আলপথ পেরিয়ে হনহন
চলে লোকটা। মৃদু কুলকুল শব্দে
ভুলুকপথে জল এগিয়ে যায় এক
সীমানা ছেড়ে অন্য সীমানার দিকে।
যাযাবরের নির্দিষ্ট নিয়মের কোনো
তোয়াক্কাই করে না সে। কাঁধে ঝুলি,
গামছা কিম্বা পাগড়ি, নিদেনপক্ষে
হাতে এক গাঁঠওয়ালা তৈলাক্ত
বাঁশের লাঠি, এ সব কিছুই তার
কাছে অনভ্যস্ত ছদ্মবেশ। মাঠের
সীমাহীন আলপথে কুয়াশায় মোড়া
ক্ষীণ দৃশ্যমানতায় এগিয়ে চলে
লোকটা তার স্বল্পকেশ আর
অনির্দেশ দৃষ্টি সম্বল।

কুকুকুকু আওয়াজে ভৈরবী রাগে
বেহালায় ছড় তোলে কোনো
মেঘনাদ পাখি। নিকুম্ভিলায় বসার
আগে বাজিয়ে নিতে চায় চারপাশের
শত্রু অবস্থান। মাঝে মাঝে
অরোমান্টিক দাড়িতে হাত বোলায়,
চুলকায় লোকটা। গতরাতের নরম
মেয়েটার সূক্ষ যোনি ভেদের উত্তাল
বৃত্তান্ত, এখন আর তার মনে নেই।
যেমন মনে নেই কাল সন্ধেয় হাতে
গোনা তিন টুকরো রুটি জুটেছিল
কিনা ঠিকঠাক! চারদিক সচকিত
করে হঠাৎ হাঁচি আসে, গুনে ঠিক
দুবার।

জীবনের যত ঝর্ণা প্রপাত, বিষাদের
সমুদ্রে কল্কেফুলের রঙ পরিবর্তন,
সব সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায় এই রাত
সকালের সন্ধিক্ষণে। চড়া সূর্যের
আলোয় নৌকাবিহীন নদীর জলে
আলোর ঝলকানি মুহূর্ত বিপর্যস্ত
করেনা স্বভাব যাযাবরকে।
উস্কোখুস্কো চুলের গোপন কোণ
থেকে উঁকি দেয় সূক্ষ রূপোলী রেখা।
কত মুখ এল গেল, কত মুখই রয়ে
গেল, হারালো অন্ধকারের নিষিদ্ধ
গলিতে। লেগে থাকে সময়ের গায়ে
কত না বোঝা অভিমান, না পাওয়া
আদর। কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না
করেই এগোয় সে জন। তার কোনো
অতীত নেই, ভবিষ্যত নেই। আছে
শুধু কুয়াশাময় নিপাট বর্তমান।

ছেঁড়া ছেঁড়া কাটা স্বপ্ননকশায় রাত্রি
পার হয়। জঙ্গলের দূর ঘনছায়ায়
খটখট শব্দে নিশিবাসর চকিতে
জাগিয়ে তোলা সাদা লক্ষ্মীবাহণ
অজর গমণ শেষে ঘরে ফিরে যায়।
সেইসব তরুণী কস্তুরী মুখ, অথবা
কস্তুরী মুখের হরিনী ছায়া,
হেমন্তভোরের চুপিচুপি অভিমান
হয়ে কুঁড়ি হয়, ফোটে, ফের ঝরে
যায় নাছোড় জাতিস্মর স্মৃতির
অক্ষম বাহক হয়ে। অগস্ত্য অভিযানে
গালের দুপাশে বলি ক্রমশঃ গভীর
হয়। আলপথ ধরে ভাঙাচোরা
অবয়ব এগিয়েই চলে সকল চাওয়ার
হাতের ধরাছোঁয়ার সীমানার বাইরে।
আঁকাবাঁকা রঙধনু দিগন্তরেখা
একবার হলেও ছোঁবেই সে।