ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রামপাল-মোংলার মানুষ ও জীববৈচিত্র

9

চয়ন মজুমদারঃ মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে গত বিংশ শতাব্দীর শেষে ও একবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশী যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও বিশ্ববাসীর মাথা ব্যাথার কারণ হচ্ছে সেটি হলো জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলা। কেন এটি নিয়ে এত আলোচনা -সমালোচনা? এ নিয়ে পরিবেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হয়েছেন। তারা বিশ্বের তাপমাত্রা কমিয়ে জীবকূল রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

বিশ্বে ধনী দেশগুলো অতিমাত্রায় কার্বন নির্গমনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর ওজন স্তরের ভারসাম্য হারাচ্ছে। গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাস অতিমাত্রায় বাড়ছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশে বনজ সম্পদ কমে যাচ্ছে। বায়ু দুষণ, পানি দুষণ ও মাটি দুষণের পরিমাণ বাড়ছে। এতে জীববৈচিত্র হুমকিতে পড়েছে।
বেশী মাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারের ফলে পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে। এতে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদী দুষণ বাড়ছে। পরিবেশ-প্রতিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উপকূলীয় এলাকার মানুষ জীবিকা হারাচ্ছে। স্থানান্তরিত হচ্ছে। খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙ্গে পড়ছে। প্রতি ৪ জনের ১ জন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। মরণঘাতি রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মানুষের শরীরে বাসা বাঁধছে। বর্তমানে পৃথিবীতে শিল্প বিপ্লবের ফলে জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার বাড়ছে। এতে কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি বৃক্ষ নিধন বাড়ছে। এতে প্রায় ২৩ প্রকার রাসায়নিক খনিজ পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে।

পৃথিবীর সকল দেশের শিল্প কারখানায়, গৃহস্থালি কাজে প্রায় ৭০ ভাগ জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানী নিয়ে ভূ-রাজনীতির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। ক্ষুদ্র ও এশিয়া উপকূলীয় এলাকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বেশী। সম্প্রতি কপের বৈঠকে ধনি দেশগুলোর সাথে জীবাশ্ম জ্বালানী কমিয়ে আনা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহার বৃদ্ধি বিষয়ে পৃথিবীর তাবত দেশ জলবায়ু সম্মেলন করেন। জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলো ক্ষতিপূরণের দাবীতে দেন দরবার করলেও আশানুরূপ ক্ষতিপূরণ মিলছে না। এবারও আজারবাইজানের বাকুতে কপ-২৯ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। জানা গেছে শেষমুহুর্তে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর দরকষাকষিতে লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ডে ৩০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যা অত্যান্ত অপ্রতুল।

জীবাশ্ম জ্বলানীর ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য ধনি দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা তা মানছে না। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় জলবায়ু অভিঘাতে শতভাগ ঝুকিতে রয়েছে। এর থেকে বেরিয় আসতে গেলে নবায়নযোগ্য জ্বলানীর ব্যবহার বাড়াতে হবে। ২০৩৫ সালের মধ্যে দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমানোর জন্যে ধনী দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাকী দেশগুলো ২০৪০ সালের মধ্যে বাকী দেশ সেই লক্ষে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ জ্বীবাস্ম জ্বালানীর ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানী বা রূপান্তরিত জ্বালানী ব্যবহারের কথা রয়েছে।

পরিবেশবাদীরা জোর দিয়ে বলছেন, আমাদের উন্নয়ন দরকার। তবে সেটি টেকসই উন্নয়ন হতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি করে কোন উন্নয়ন নয়। জীবাশ্ম জ্বালানীর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানী আমাদের সময়ের দাবী। আমাদের প্রাকৃতিক উৎসে রয়েছে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর আধার। যেমন, সূর্যের আলো, বায়ু প্রবাহ, জল প্রবাহ, জৈব শক্তি (জৈব ভর), ভূ-তাপ, সামুদ্রিক তরঙ্গ ও সমুদ্র তাপ। এগুলো নিয়ে বিগত সরকারের আমলে কিছু কাজ হলেও তা খুবই সীমিত। নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহারে ধীরগতি পরিলক্ষিত হয়। দেশে মাত্র এক চতুর্থাংশের ও কম নবায়নযোগ্য জ্বালনী ব্যবহার হচ্ছে। পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও তা নিয়ে নানান উদ্বেগ দেখা গেছে।

 

আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের পরিবর্তে জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের ফুসফাস খ্যাত সুন্দরবনের সন্নিকটে কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করলো আওয়ামীলীগ সরকার। দেশী বিদেশী পরিবেশবাদী সংগঠনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে রাজনৈতিকভাবে ইন্ডিয়াকে খুশি করতে এবং প্রকল্পের নামে লুটপাট করতে রামপালে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র করলো আওয়ামী সরকার। ইতিমধ্যে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়াও রামপাল ও মোংলায় অপরিকল্পিতভাবে ২০০ বেশী শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। অধিকাংশ শিল্প কারখানা ইটিপি মানছে না। তারা বিভিন্নভাবে নদী দুষণ করছে।

 

নদীতে অপরিশোধিত বর্জ্য, পোড়া তেল, ক্ষতিকর পারদ ও সিসার মারাত্মক দুষণ ঘটছে। পারদ ও সিসার পরিমান বেড়ে যাওয় এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র হুমকিতে পড়েছে। ভেঙ্গে পড়েছে খাদ্য শৃঙ্খল। মানুষের মধ্যে মরণঘাতি অসংক্রামক রোগ বাসা বাঁধছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা বেশী ঝুতিতে পড়েছে। নদীতে উদ্বেগজনকহারে সিসার পরিমান বেড়ে গেছে। এতে নদ-নদীর মৎস্য সম্পদ ধ্বংসের পথে। ইতিমধ্যে আমাদের নদী খালের অনেক মাছের প্রজাতি নিঃশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। দুষিত মাছ বা প্রাণীজ আমিষ আমাদের ক্ষতি করছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র সহ-সম্পাদক নূর আলম শেখ বলেন, সবুজ পৃথিবী গড়তে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর মধ্যে সৌর শক্তি সবথেকে সহজলভ্য এবং সম্ভবনাময়। এছাড়াও বায়োগ্যাসের রয়েছে সীমিত সম্ভবনা। বায়ু বিদ্যুৎ এর সম্ভবনা গবেষণাধীন। কয়লার দুষণ থেকে বেরুত হবে। জ্বীবাস্ম জ্বলানী নয়, নবায়নযোগ্য জ্বালানীতে রূপান্তর করতেই হবে। পরিবেশবাদীসহ সকল সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। বাঁচাতে হবে পৃথিবী। বাসযোগ্য হোক পৃথিবী।