ইস্কাটন রোডের ফ্ল্যাটে কী হয়েছিল সেই শুক্রবারে

60

সেদিনও ছিল আজকের মতো ছুটির দিন, শুক্রবার। আজ থেকে ঠিক ২৮ বছর আগে। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। ওই দিন শরতের সকালে সমকালীন ঢাকাই চলচ্চিত্র অঙ্গনে সব থেকে বড় শূন্যতা তৈরি করে বিদায় নিয়েছেন সালমান শাহ। যাঁর পারিবারিক নাম শহীদ চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন। ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মা নীলা চৌধুরী। সালমান ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে।
এসেছিলেন ১৯৭১-এ, চলে গেলেন ১৯৯৬-তে। মাত্র ২৫ বছর। গড় আয়ুর তুলনায়ও একেবারেই নগণ্য বয়স। এত অল্প সময়ে কেন চলে গেলেন তিনি, কেন চলে যেতে হলো—সেই রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি। চলছে বিচার। আসলে কী ঘটেছিল সেদিন, তা এখনো রহস্যের ভেতর আছে, তবে সেদিনের ঘটনাগুলো বিভিন্ন সময়ে নিকটজনদের বয়ানে পাওয়া যায়।
চিত্রনায়ক সালমান শাহ তখন থাকতেন রাজধানী ঢাকার নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার একটি ফ্ল্যাটে। সেদিন সকাল সাতটায় বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী ছেলে শাহরিয়ার চৌধুরী ইমনের সঙ্গে দেখা করতে ইস্কাটনের বাসায় যান। কিন্তু ছেলের দেখা না পেয়ে তিনি ফিরে আসেন। সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী বলেন, বাসার নিচে দারোয়ান সালমান শাহর বাবাকে তাঁর ছেলের বাসায় যেতে দিচ্ছিলেন না। নীলা চৌধুরীর বর্ণনা ছিল এ রকম, ‘বলেছে স্যার এখন তো ওপরে যেতে পারবেন না। কিছু প্রবলেম আছে। আগে ম্যাডামকে (সালমান শাহর স্ত্রীকে) জিজ্ঞেস করতে হবে। একপর্যায়ে উনি (সালমান শাহর বাবা) জোর করে ওপরে গেছেন। কলবেল দেওয়ার পর দরজা খুলল সামিরা (সালমান শাহর স্ত্রী)। উনি (সালমান শাহর বাবা) সামিরাকে বললেন, “ইমনের (সালমান শাহর ডাকনাম) সঙ্গে কাজ আছে, ইনকাম ট্যাক্সের সই করাতে হবে। ওকে ডাক।” তখন সামিরা বলল, “ও তো ঘুমে।” তখন উনি বললেন, “ঠিক আছে আমি বেডরুমে গিয়ে সই করিয়ে আনি।” কিন্তু যেতে দেয়নি। আমার হাজব্যান্ড ঘণ্টা দেড়েক বসে ছিল ওখানে।’

বেলা ১১টার দিকে একটি ফোন আসে সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরীর বাসায়। ওই টেলিফোনে বলা হলো, সালমান শাহকে দেখতে হলে তখনই যেতে হবে। টেলিফোন পেয়ে নীলা চৌধুরী দ্রুত ছেলে সালমান শাহর বাসার দিকে রওনা হয়েছিলেন। তবে সালমানের ইস্কাটনের বাসায় গিয়ে ছেলে সালমান শাহকে বিছানার ওপর দেখতে পান নীলা চৌধুরী। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘খাটের মধ্যে যেদিকে মাথা দেওয়ার কথা, সেদিকে পা। আর যেদিকে পা দেওয়ার কথা সেদিকে মাথা। পাশেই সামিরার (সালমান শাহর স্ত্রী) এক আত্মীয়ের একটি পারলার ছিল। সেই পারলারের কিছু মেয়ে ইমনের হাতে-পায়ে শর্ষের তেল দিচ্ছে। আমি তো ভাবছি ফিট হয়ে গেছে। আমি দেখলাম, আমার ছেলের হাত-পায়ের নখগুলো নীল। তখন আমি আমার হাজব্যান্ডকে বলেছি, আমার ছেলে তো মরে যাচ্ছে।’

১৯৯৪ সাল। তখন সালমান শাহর বয়স মাত্র ২৩।
১৯৯৪ সাল। তখন সালমান শাহর বয়স মাত্র ২৩।

ইস্কাটনের বাসা থেকে সালমান শাহকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে বলা হয়, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। তবে বিষয়টি এখনো বিচারাধীন। সালমানের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে না পারায় তাঁর ভক্তদের মধ্যে তৈরি হয় নানা প্রশ্নের।

বরাবরই পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে। নীলা চৌধুরীর অভিযোগ ছিল, তাঁরা হত্যা মামলা করতে গেলে পুলিশ সেটিকে অপমৃত্যুর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে। পুলিশ বলেছিল, অপমৃত্যুর মামলা তদন্তের সময় যদি বেরিয়ে আসে যে এটি হত্যাকাণ্ড, তাহলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হত্যা মামলায় মোড় নেবে।

আগের দিন বৃহস্পতিবার যা ঘটেছিল
৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ‘প্রেমপিয়াসী’ ছবির ডাবিং করতে এফডিসিতে গিয়েছিলেন সালমান শাহ। সেখানে ডাবিংয়ের জন্য আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন এই ছবির নায়িকা শাবনূর।

তাঁর সময়ের সবচেয়ে স্টাইলিশ তারকা ছিলেন সালমান শাহ। ছবি: ফেসবুক সালমান শাহের ফ্যান পেজ
তাঁর সময়ের সবচেয়ে স্টাইলিশ তারকা ছিলেন সালমান শাহ। ছবি: ফেসবুক সালমান শাহের ফ্যান পেজ

এফডিসিতে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর সালমান বাবাকে ফোন করে বলেন, তাঁর স্ত্রী সামিরাকে নিয়ে এফডিসির সাউন্ড কমপ্লেক্সে আসার জন্য। ফোন পাওয়ার পরপরই সালমানের বাবা সামিরাকে নিয়ে এফডিসি আসেন। শ্বশুরের সঙ্গে সাউন্ড কমপ্লেক্সে এসে সামিরা দেখতে পান, সালমান ও শাবনূর ডাবিং রুমে খুনসুটি করছেন।

ওই সময়ের বেশ কিছু বিনোদন পাক্ষিক এবং সালমানকে নিয়ে একাধিক গ্রন্থে লেখা হয়েছে, সালমানকে শাবনূরের সঙ্গে খুনসুটি করতে দেখে রেগে যান সামিরা। সালমানের বাবা চলে যাওয়ার পর সামিরাও দ্রুত গাড়িতে ওঠেন। ‘অবস্থা জটিল’ বিষয়টি বুঝতে পেরে একই গাড়িতে ওঠেন সালমান শাহ ও চিত্রপরিচালক বাদল খন্দকার। কিন্তু গাড়িতে বসে সালমানের সঙ্গে কথা বলেননি সামিরা। তাঁকে বোঝাতে থাকেন বাদল খন্দকার। গাড়ি এফডিসির গেট পর্যন্ত গেলে সালমান প্রধান ফটকের সামনে নেমে যান। তাঁর সঙ্গে বাদল খন্দকারও নেমে পড়েন। এরপর সেখানে কিছুক্ষণ আড্ডা দেন। এরপর ডাবিং রুমে ফিরে গেলেও সেদিন আর ডাবিং হয়নি।

তিনি অভিমানী এক নক্ষত্র
তিনি অভিমানী এক নক্ষত্রসংগৃহীত

পরে রাত ১১টার দিকে নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার বি-১১ নম্বর ফ্ল্যাটে সালমানকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেন বাদল খন্দকার। বাসায় ফেরার পর রাতের ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন রকমের বক্তব্য পাওয়া যায় সে সময়ের পত্রিকাগুলোতে। তবে সেসব বক্তব্য প্রত্যক্ষদর্শী কারও বয়ানে ধারণ করা নেই।

প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চলচ্চিত্র পরিচালক বাদল খন্দকার জানান, তিনি পরদিন সকালেই সালমানের বাসায় গিয়েছিলেন। বাদল খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ছবির কাজের শিডিউল নিতে তিনি সকালে সেখানে গেলে বাসার নিচে দারোয়ানরা তখন বলাবলি করছিলেন, সালমান রাতেই ফাঁস দিয়ে মারা গেছেন।

চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে তাঁর জুটি জনপ্রিয় হয়েছিল
চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে তাঁর জুটি জনপ্রিয় হয়েছিলসংগৃহীত

চলচ্চিত্র পরিচালক শাহ আলম বলেন, শেষের দিকে অনেক মানসিক চাপে ছিলেন সালমান শাহ। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং প্রযোজকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। কিছুদিন নিষিদ্ধ হয়েছিলেন সমিতির কাছে।

আজ ৬ সেপ্টেম্বর। শুক্রবার। ২৮ বছর আগে ঢাকায় চলচ্চিত্রে রাজত্ব করা মানুষটি আজ অনতিক্রমণীয় দূরত্বে। তিনি কী দেখছেন ছেড়ে যাওয়া ভক্ত ও অনুরাগীরা কী গভীর শ্রদ্ধা আর নিখাদ ভালোবাসায় স্মরণে রেখেছে তাঁকে? এ প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘তুমি আমার’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘বিক্ষোভ’, ‘প্রেমযুদ্ধ’, ‘দেনমোহর’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘আঞ্জুমান’, ‘বিচার হবে’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘জীবন সংসার’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘আনন্দ অশ্রু’র মতো ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রের ভেতর; নিজ অভিনয় গুণে। বেঁচে থাকবেন ভক্তদের অন্তরে।

 আজ ২৭ বছর হলো মারা গেছেন
২৭ বছর হলো মারা গেছেন সংগৃহীত