বাংলাদেশকে ফিনল্যান্ড বানাতে চেয়েছিলেন যারা

91

স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশ ফিনল্যান্ড। এখানে প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়েই শিক্ষক নিয়োগের কার্যক্রমটি পুরোপুরি মেধাভিত্তিক ও উচ্চ পর্যায়ের প্রশিক্ষণনির্ভর। শিক্ষকদের বেতনও অনেক বেশি। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে স্থানীয় মুদ্রায় নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের একজন শিক্ষকের সর্বনিম্ন মাসিক বেতন প্রায় ৩ হাজার ৩১৮ ডলারের সমপরিমাণ, যা বাংলাদেশে সমপর্যায়ের একজন শিক্ষকের বেতনের তুলনায় প্রায় ২৮ গুণ। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও অনেক বেশি। এ কারণে দেশটির সবচেয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায়ই আগ্রহ দেখা যায় সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশেও ‘ফিনল্যান্ডের আদলে একই ধরনের শিক্ষাক্রম’ চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। যদিও এ শিক্ষাক্রমকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের পূর্বশর্তগুলো উপেক্ষিতই থেকে যায়। নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য প্রণীত পাঠ্যপুস্তক নিয়েও ছিল মানহীনতার অভিযোগ। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে প্রচুর অর্থ ব্যয় হলেও এর মান নিয়েও প্রশ্ন ছিল শুরু থেকেই। অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয় গত বছর। সে সময় নতুন শিক্ষাক্রম ও এর জন্য প্রণীত পাঠ্যপুস্তক নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। অভিযোগ ওঠে, এ শিক্ষাক্রম তৈরি করতে গিয়ে দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। আবার নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিকে বইয়ের কনটেন্টও ছিল নিম্নমানের। যদিও তৎকালীন সরকারের দাবি ছিল, নতুন এ শিক্ষাক্রম তৈরি হয়েছে ফিনল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার আদলে।

নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি এবং এর জন্য পাঠ্যপুস্তক গ্রন্থনার সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাগুলোর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি শিক্ষাবিদরাও জড়িত ছিলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির সদস্য শিক্ষাবিদদের মধ্যে ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. অমল কৃষ্ণ হালদার, রোবোটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. লাফিফা জামাল, মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ইকবাল রউফ মামুন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আবুল মোমেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ প্রমুখ। এছাড়া পদাধিকারবলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা সদস্যদেরও এ কমিটিতে রাখা হয়।

এ শিক্ষাক্রম প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এনসিটিবির দুই চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা এবং ফরহাদুল ইসলাম, শিক্ষাক্রম (মাধ্যমিক) সদস্য অধ্যাপক ড. মশীউজ্জামান এবং শিক্ষাক্রম (প্রাথমিক) সদস্য প্রফেসর মো. মোখলেস উর রহমান। মূলত শিক্ষাক্রম প্রণয়নসংক্রান্ত গবেষণা এবং পাইলটিং প্রজেক্টগুলো তাদের অধীনেই সম্পন্ন হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শিক্ষাক্রমসংক্রান্ত কাজগুলো মূলত সরাসরি চেয়ারম্যান এবং ড. মশীউজ্জামানের অধীনেই পরিচালিত হতো। পাঠ্যপুস্তক কীভাবে তৈরি হবে, কী কী পরিবর্তন আসবে এসব কিছু তারাই নিয়ন্ত্রণ করতেন। এছাড়া ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং ড. এম তারিক আহসান এ শিক্ষাক্রম তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন।

দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১৭ সালের দিকে। উদ্যোগ গ্রহণের পরপরই এ নিয়ে গবেষণা ও সমীক্ষা কার্যক্রম শুরু করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। শুরু থেকেই এ গবেষণা ও সমীক্ষা কার্যক্রম দায়সারাভাবে পরিচালিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও দুর্বল দিকগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত না হওয়ায় এটি চালুর পরপরই নানা অভিযোগ আসতে থাকে। এর পর গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন না করে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও এরই মধ্যে এর পেছনে ব্যয় হয়েছে প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা।

মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি স্কুলে শিক্ষকদের বেতন বিবেচনায় বাংলাদেশ এশিয়া তথা গোটা বিশ্বেই সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর অন্যতম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেধাবীদের এ পেশায় তেমন একটা আগ্রহী হতে দেখা যায় না। আবার শিক্ষকতায় যারা যোগ দেন, তাদেরও বেশির ভাগেরই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ থাকে না।

অভিযোগ আছে, ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করা হয়। পরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও এর মান নিয়ে তাদের পক্ষ থেকে তোলা হয় বিস্তর অভিযোগ। নতুন এ শিক্ষাক্রমের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন শিক্ষকরা আর এর প্রভাব পড়ছিল শ্রেণীকক্ষেও। অভিভাবকরা অভিযোগ তোলেন, নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী পড়তে গিয়ে শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি গুগলনির্ভর হয়ে উঠছেন।

এছাড়া শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে। আগে শিক্ষার্থীদের নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ব্যবসায় শিক্ষা, মানবিক অথবা বিজ্ঞান বিভাগ বেছে নেয়ার সুযোগ থাকলেও নতুন শিক্ষাক্রমে সে সুযোগ রাখা হয়নি। নতুন শিক্ষাক্রমে সব শিক্ষার্থীর জন্যই বাধ্যতামূলকভাবে সাধারণ ১০টি বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর ফলে আগে যেখানে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের বিভাগভিত্তিক বিষয়ে অন্তত ৪০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো, সেখানে নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানে নম্বর কমে এসেছিল ১০০-তে। ওই সময় শিক্ষাবিদদের দাবি ছিল, সমন্বিতভাবে সব পড়ানো হলে শিক্ষার্থীরা সবকিছু সঠিকভাবে শেখার সময় পাবে না। বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষায় আরো অনাগ্রহী হয়ে পড়তে পারে তারা।

বিগত কয়েকটি কারিকুলাম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৯০ সালের পর এ শিক্ষাক্রমেই মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানে সবচেয়ে কম প্রাধান্য দেয়া হয়। ১৯৯০ সালেও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ১১ বিষয়ে মোট ১ হাজার নম্বরের পরীক্ষা হতো। এর মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য মোট নম্বর ছিল ৩০০, যা ছিল মোট নম্বরের ৩০ শতাংশ। ২০০০ সালে এসএসসিতে মোট বিষয় ছিল ১১টি। নম্বর ছিল ১ হাজার ১০০। এর মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য বরাদ্দকৃত নম্বর ছিল ৪০০। ওই সময়ে মোট নম্বরের ৩৬ শতাংশ ছিল বিজ্ঞানে। ২০১৭ সালে মোট বিষয় ছিল ১৪টি। এর জন্য মোট নম্বর ছিল ১ হাজার ৩০০। এর মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোয় বরাদ্দ ছিল ৪০০ বা মোট নম্বরের ৩১ শতাংশ। আর নতুন শিক্ষাক্রমে নবম-দশম শ্রেণীতে মোট বিষয় রাখা হয় ১০টি। সে হিসেবে ১ হাজার নম্বরের পরীক্ষায় বিজ্ঞানে ছিল ১০০, যা মাধ্যমিক পরীক্ষায় মোট নম্বরের মাত্র ১০ শতাংশ।

নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য সরবরাহকৃত পাঠ্যপুস্তকে কনটেন্টের মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বিশেষত ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর বিজ্ঞান বই নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা তৈরি হয়। এ বই গ্রন্থনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন ড. জাফর ইকবাল। অভিযোগ ছিল, এ বইয়ের কনটেন্টগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ গুগল থেকে সরাসরি অনুবাদ করা। এমনকি বিদেশী বিভিন্ন ব্লগ থেকেও কপি-পেস্ট করা হয়েছে। এছাড়া সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস এবং সামাজিক বিজ্ঞান বইয়েও বিতর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ ওঠে।

এদিকে শিক্ষাক্রমটি বাতিল হলেও এরই মধ্যে এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে দুই বছরে শুধু শিক্ষক প্রশিক্ষণেই ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৯ কোটি টাকা। যদিও এ প্রশিক্ষণের মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল শুরু থেকেই। এছাড়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিশ্বব্যাংকের ঋণে ৩ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘লার্নিং এক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন (লেইস)’ প্রকল্পও শুরু করা হয়েছিল। এর পাশাপাশি বিশেষ অ্যাপ ‘নৈপুণ্য’ তৈরিসহ আরো কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নতুন শিক্ষাক্রমকে বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও। এ শিক্ষাক্রম নিয়ে তার বক্তব্য ছিল, ‘অনেক ক্ষেত্রেই নতুন এ শিক্ষাক্রম আমাদের দেশের জন্য উপযুক্ত নয়। আমাদের যেসব শিক্ষক আছেন, তাদের দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। বিশেষ করে পরীক্ষা মূল্যায়ন পদ্ধতি। এ কারণে যতদূর পারি আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাব। তবে এটি এমনভাবে করা হবে, যাতে যেসব শিক্ষার্থী নতুন শিক্ষাক্রমে আছেন, তাদের কোনো অস্বস্তি না হয়। এজন্য পরিমার্জন করা হবে। তবে শিক্ষার্থীরা অস্বস্তিতে পড়তে পারে, এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না। এরই মধ্যে এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দিয়ে পরিপত্রও প্রকাশ করা হয়েছে।’